আহবাব চৌধুরী খোকন ।। সম্পাদকীয়
অবশেষে বাংলাদেশের স্মরণ কালের ঘৃনিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। দেশের সাহসী সন্তানেরা গণভবন দখল করে হাসিনাকে শুধু পদত্যাগ নয়, দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে।দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম না হলে হাসিনাকে হয়তো ছাত্রসমাজের পায়ের তলায় পৃষ্ট হয়ে জীবন দিতে হতো।সুহৃদ পাঠক সাধারণ মানুষের কতটা ক্ষোভ ও ঘৃনা থাকলে এমনটি হতে পারে নিশ্চয় আপনারা উপলব্দি করতে পেরেছেন ।আমাদের দেশে একটি কথা আছে,” তোড় গাঙ্গ বেশী দিন বয় না।” অর্থাৎ যে নদীতে বেশী স্রোত প্রবহমান থাকে সে নদী নিরবদি হয় না।পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার ক্ষেত্রে তাহাই হয়েছে ।জন গনের উপর নির্যাতন চালাতে গিয়ে সকল মানুষ কে ক্ষেপিয়ে তোলায় শেষ পর্যন্ত আর গদি রক্ষা করতে পারেনি হাসিনা ।শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে পুরো দেশকে একদল ও একনেতার দেশে পরিণত করেছিলো ।গণ গ্রেফতার,গণহত্যা ও গণধর্ষন সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ
করে তুলেছিলো ।কেউ স্বাধীণ ভাবে কথা বলতে পারতো না।এমনকি সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্টেটাস দিতেও ভয় পেতো ।১৯৭১ সাল দেশের স্বাধীণতা অর্জন ছিলো একটি দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল।শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সরওয়ার্দি, মাওলানা ভাষানী, জেনারেল ওসমানী,শহিদ জিয়াউর রহমান প্রমুখ জাতীয় নেতারা দেশের স্বাধীণতা অর্জনে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায়
গিয়ে এমন ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন যে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া দেশের স্বাধীণতা অর্জনে আর কারো কোন অবদান ছিলো না। দলীয়করণ ও পারিবারিক করণের এমন নজির স্থাপন করলেন যে দেশের মানুষকে মানুষ হিসাবে হিসাবে গণ্য করতে ভুলে গেলেন ।পুলিশ ও কোট কাচারী দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। ছাত্র সমাজ যখন সরকারের নিকট সরকারী চাকুকীতে বৈসম্যমুক্ত একটি কোটা দাবী করেছিলো তখন সরকার শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধানের চেষ্টা না করে পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের উপর বুলেট, টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে ও হত্যার পথ বেচে নিয়ে তাদের দাবীকে অবজ্ঞা করলেন ।পুলিশের নির্বিচার গুলীতে অনেক ছাত্র, শিশু এমনকি সাধারণ মানুষও প্রাণ হারায় ।পরে সাধারণ ছাত্র সমাজ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললে এর মাশুল দিতে হয় অবৈধ সরকারকে।শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী নামিয়ে,কার্ফ্যু জারী করে ও দেখা মাত্র গুলীর নির্দেশ দিয়েও আর গদি রক্ষা করতে পারেনি ।
শেখ হাসিনা ভেবেছিলো পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বানচাল করা তার নিকট কিছুই না ।তাই ছাত্র সমাজের ক্ষোভ ও মনোভাবকে বিবেচনায় না নিয়ে এটিকে নাশকতায় রূপ দেয়ার চেষ্টা করে । আন্দোলনরত ছাত্র ছাত্রীকে দুষ্কৃতকারী ও দুর্বৃত্ত এমনকি রাজাকার বলে অভিহিত করতে কুন্ঠিত হয়নি। তবে এবারের ছাত্র আন্দোলন দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে ।রাজনৈতিক দল গুলো সরকার পতনের দাবীতে দীর্ঘ দিন যাবৎ আন্দোলন করে সফলতা অর্জন করতে না পারলেও মাত্র এক সপ্তাহের তীব্র ছাত্র আন্দোলন অবৈধ সরকারের গদিকে দোলার
মত উড়িয়ে দিয়েছে। গত দেড় দশকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন শেখ হাসিনা পুলিশ দিয়ে দমন করতে সক্ষম হলেও কোটার দাবীতে গড়ে উটা ছাত্র আন্দোলন দেশের পুরো চিত্রকে বদলে দেয় ।সরকারী চাকুরীতে ৫৬ ভাগ কোটা সংরক্ষনের সিন্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে সরকার মূলত দেশে দলের অনুগত একটি প্রশাসন গড়ে তুলতে চেয়েছিলো ।কিন্তু সাধারণ ছাত্রসমাজ দীঘ দিন যাবৎ বঞ্চিত হতে হতে তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে টেকে যাওয়ায় এই বঞ্চনাই শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণে রূপ নেয়।ফলে আন্দোলন বানচাল করার কোন কৌশল কাজে আসেনি ।ছাত্রসমাজের দাবী যৌক্তিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাতে সমর্থন করে ।অভিবাবক থেকে শুরু করে রিক্সাচালক, কুলি ও মজুরসহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমর্থন তাদের মনোবল ও সাহসকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।ফলে জনগনের সম্মেলিত শক্তির নিকট পতিত স্বৈরাচারী সরকারের কোন প্রেসক্রি পশন কাজে আসেনি।তাই গুলি, লাটি ও হুমকি টেকিয়ে রাখতে পারেনি গদি রক্ষার কৌশল।ছাত্রদের উপর পুলিশি নির্যাতন ও গুলী বর্ষনের সিন্ধান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জনমনে।
ফলে গত কয়েকদিনে দেখেছি বহু বিবেকবান আওয়ামী লীগ সমর্থকও ছাত্র সমাজের আন্দো লনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলন শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি ।ছড়িয়ে পড়ে ছিলো দেশের বাহিরে।গত সপ্তাহে লন্ডন,ইটালী ও সুইজ্যারল্যান্ড ঘুরে সর্বত্র চোঁখে পড়েছে প্রবাসী সাধারণ মানুষের ক্ষোভ , বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ।নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ার, ইংল্যান্ডের আলতাফ আলী পার্ক ও অষ্ট্রেলিয়া, ইটালী সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।দেশের বাহিরে লন্ডন ও নিউইয়র্কে সাধারণ মানুষের হাতে আওয়ামী লীগ নেতারা নাজেহাল হয়েছে।এই আন্দোলনে অনেক জায়গায় ভেঙ্গে পড়ে আইনের শাসন।বহু জায়গায় জনগন সরকারী স্থাপনা ও শেখ মুজিবুর রহমান এর নামে গড়ে তোলা প্রতিষ্টান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের অফিস ও বাসাবাড়িতে আগুন দিয়েছে ।আওয়ামীলীগ নেতাদের কিছু ঔদাত্বপূর্ণ বক্তব্য গনমানুষের ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো।ছাত্র সমাজের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে আমলে না নিয়ে সরকার ছাত্রলীগ দিয়ে দমনের অপচেষ্টা চালিয়ে হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়েছে ।ফলে নিহত হয় কয়েক শতাধিক ছাত্র।এমন নির্মম গনহত্যা আইয়ুব, ইহাহিয়া,মার্কোস, গাদ্দাফি, ফেরাউনের নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে।সব মিলিয়ে এভাবে আওয়ামীলীগ নিজেই নিজের কবর রচনা করে ।
কথায় আছে অহংকার পতনের মূল। ক্ষমতা পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের এতোটা অহংকারী করে তুলেছিলো যে তারা মানুষকে মানুষ হিসাবে ভাবতে ভুলে গিয়েছিলো। পুরো দেশকে একটি টর্চার সেলে পরিণত করে ছিলো। তাদের আষ্কারা পেয়ে পুলিশ যে রাষ্ট্রের কর্মচারী এটা তারা ভুলে গিয়েছিলো। পুলিশের আইজি ও র্যাব প্রধানের কথা শুনলে মনে হতো তারা দেশের মালিক ।বিনা বিচারে যখন তখন যে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া ,খুন গুম ও নির্যাত নের এমন এক পরিবেশ দেশে গড়ে তুলে ছিলো যে জনগনের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা ।দুর্নীতি ও দুবৃত্তায়ন সারা দেশে মাথা ছাড়া দিয়ে উটে । বিদেশে টাকা পাচার স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয় ।দখলদার সরকারের প্রধান নিজে স্বীকার করে তার পিয়ন এখন চারশত কোঠি টাকার মালিক ।প্রশ্নপত্র ফাঁসের রমরমা ব্যবসা করে সামান্য গাড়ী চালক হাজার কোটি টাকার মালিক ।দুর্নীতির এমন নজির সমকালীন
বিশ্বে দেখা যায়নি।অন্যদিকে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিপক্ষ হওয়াতে বিএনপি নেতাকর্মী রা নির্যাতিত হয়েছে সবচেয়ে বেশী।মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও দেশের বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রায়
এক যুগ যাবৎ হাউস এরেষ্ট করে রাখা হয়েছে।বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কে মিথ্যা মামলায় সাজানো রায় দিয়ে দেশে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব সহ অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে শতশত মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুরো দেশে নরকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথকে বন্ধ করে রাখা হয়। জনগনের উপর স্টিম রোলার চালিয়ে পৃথিবীতে কোন স্বৈরাচারী সরকার টিকে থাকতে পারেনি তাই শেখ হাসিনা সরকারেরও পতন হয়েছে।এই পতন থেকে দেশের সকল রাজনীতিবিদদের অনেক শিক্ষা নেয়ার আছে।গণতান্ত্রের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করলে কারো পরিনাম শুভ হয় না শেখ হাসিনার পতন সে কথাই মনে করিয়ে দিলো ।দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন বিরাজমান থাকলে হাসিনাকে ক্ষমতা হারালেও দেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না।
এখন দেশের দায়িত্বভার যে সরকারের হাতে অর্পিত হয়েছে তাদের প্রথম কাজ হবে দেশে আইনের শাসন কায়েম করা।কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবী আদায় করতে গিয়ে যে সকল নিরীহ ও নিরাপদ ছাত্রকে নির্দয় ভাবে সরকারী মদদে জীবন দিতে হয়েছে তাদেরকে জাতীয় বীরের মর্যাদা প্রদান করে উপযুক্ত ক্ষতি পূরণ দিতে
হবে ।গণহত্যায় জড়িত সকল পুলিশ কর্মকর্তা
ও আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের আইনের হাতে সপোর্দ করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান করতে
হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরার্ভিত্তি দেখতে না হয়।তাছাড়া বিনা ভোটে নির্বাচিত সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ,উপজেলা
ও জেলা পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে দেশে জনগনের সমতা প্রতিষ্টা করতে হবে।সেই সাথে এই মুহুর্তে প্রত্যেক নাগরিককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা বাঞ্চনীয় ।পতিত স্বৈরশাসকের জায়গায় দেশে মানুষ নতুন করে আর কোন স্বৈরশাসককে দেখতে চায় না।মানুষ নির্বিচারে গন হত্যার জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোষরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। গণতন্ত্র চায়, আইনের শাসন চায়, ভোট দেয়ার অধিকার চায়, বৈসম্যমুক্ত রাষ্ট্র চায়, যেথানে ন্যায় সঙ্গত দাবীর কথা বললে মানুষকে এভাবে নিগৃহিত হতে হবে না। এই জন্য দল মত নির্বিশেষে সবাইকে দেশের জন্য এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে । হাসিনার পতন ঘটাতে আমরা যেভাবে এক যুগে রাজপথে নেমে এসে ছিলাম আসুন সমান শক্তি নিয়ে দেশ বাঁচাতে কাজ শুরু করি। আর কোন স্বৈরাচারী সরকার নয় । দেশের মানুষ আগামী দিনে দেশে একটি দেশপ্রেমিক সরকার ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা দেখতে চায় ।